রাখাইনের আন শহরে এখন আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে: আরাকান আর্মি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আঞ্চলিক সেনা সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেছে রাজ্যটির জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। এর মধ্য দিয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ে দ্বিতীয় কোনো আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ হারাল ক্ষমতাসীন জান্তা।

শুক্রবার গভীর রাতে টেলিগ্রামে দেওয়া এক বিবৃতিতে আরাকান আর্মি বলেছে, ‘দুই সপ্তাহ ধরে তীব্র লড়াইয়ের পর শুক্রবার রাখাইনের আন শহরে অবস্থিত জান্তা বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের পতন হয়েছে। এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন আমাদের হাতে।’ তবে এ ব্যাপারে জান্তা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ এই সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ হারানো জান্তা সরকারের জন্য বড় ধাক্কা। কেননা এটি ছিল রাখাইনে জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটি।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ড রয়েছে ১৪টি। এসব কমান্ডের অধীনে নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে সামরিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর আগে গত আগস্টে চীন সীমান্তবর্তী শান রাজ্যের রাজধানী লাশিওতে অবস্থিত উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয় বিদ্রোহীরা। এটি ছিল বিদ্রোহীদের দখলে যাওয়া প্রথম কোনো আঞ্চলিক সেনা কমান্ড।

ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, আন শহরে জান্তার আঞ্চলিক সেনা সদর দপ্তরের ভবনগুলো থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়ছে। হামলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভবনগুলোর বড় একটি অংশ। এর আগে গত মঙ্গলবার একটি ভিডিও প্রকাশ করে আরাকান আর্মি। তাতে দেখা যায়, জান্তা বাহিনীর কয়েক ডজন সেনা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করে রেখেছেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা।

আরাকান আর্মির মুখপাত্র খাইং থুখা দেশটির সংবাদমাধ্যম ইরাবতীকে বলেন, ‘রাখাইনে জান্তা বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থাউং তুন ও চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার কিয়াও কিয়াও থানকে আটক করা হয়েছে। জান্তা বাহিনীর কিছু সেনা পালিয়ে গেছেন। তাঁদের ধরতে আমাদের অভিযান চলছে।’ তবে জান্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে এখনো বিমান হামলা চলছে বলে জানান তিনি।

এর আগে ৬ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি এক বিবৃতিতে দাবি করে, আন শহরে অবস্থিত জান্তার ৩০টির বেশি ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। এসব ঘাঁটির মধ্যে বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তরও রয়েছে। তখন রাখাইনের জাতিগত এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী জানিয়েছিল, এখন শুধু পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া বাকি।

গত বছরের নভেম্বরে রাখাইনে জান্তা বাহিনীর ঘাঁটি ও অবস্থান নিশানা করে বড় পরিসরে হামলা শুরু করে আরাকান আর্মি। এর পর থেকে রাজ্যটির ১৭টি শহরের ১২টির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহীরা। অন্য শহরগুলোতে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলছে। এ ছাড়া পাশের শান রাজ্যের সীমান্তবর্তী শহর পালেতোয়ার নিয়ন্ত্রণও নিয়েছে আরাকান আর্মি।

সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সীমান্ত–লাগোয়া শহর মংডুর নিয়ন্ত্রণ নেয় আরাকান আর্মি। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত পুরোপুরি আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। এখন শুধু রাজ্যটির রাজধানী সিত্তে জান্তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

জান্তার নিয়ন্ত্রণে মাত্র ২১ শতাংশ ভূখণ্ড

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এক অভ্যুত্থানে অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তখন থেকেই দেশটিতে অস্থিরতা চলছে। সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। গণবিক্ষোভে হাজার মানুষ নিহত হলে তা রূপ নেয় সশস্ত্র লড়াইয়ে। এরপর সশস্ত্র এই লড়াইয়ে বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো যোগ দেয়।

গত বছরের ২৭ অক্টোবর তিনটি জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী জোটবদ্ধভাবে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বড় পরিসরে অভিযান শুরু করে, যা ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে বেশি পরিচিত। এ জোটে আরাকান আর্মি ছাড়াও রয়েছে কোকাং অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও শান রাজ্যের তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)।

এর এক বছর পর গত নভেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ মিয়ানমারের ১৪ হাজারের বেশি গ্রাম নিয়ে একটি জরিপ করে বিবিসি। এসব গ্রাম কাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তা যাচাই করে দেখা হয়েছে ওই জরিপে। দেখা গেছে, সংঘাত শুরুর প্রায় চার বছর পর মিয়ানমারের মাত্র ২১ শতাংশ ভূখণ্ডে সামরিক বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আর ৪২ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে জাতিগত বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। বাকি অঞ্চলগুলোয় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াই চলছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস–এর ইয়ে মায়ো হেইন বলেন, মিয়ানমারের জান্তা আর আগের মতো ক্ষমতাধর নেই। বিদ্রোহীদের অব্যাহত হামলার মুখে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্তা বাহিনী এখন অনেকটা কোণঠাসা। অনেক সেনা পালিয়ে গেছেন। অনেকে নিহত হয়েছেন। জান্তা বাহিনীতে সেনা আছে এখন ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো। তবে সীমান্ত অঞ্চল ও ছোট ছোট শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারালেও রাজধানী নেপিডোসহ বড় বড় শহরগুলো এখনো জান্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *